ডয়চে ভেলে প্রতিবেদন
সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতির খবর নতুন নয়৷ তবে এ নিয়ে আলোচনায় নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে পুলিশের সাবেক প্রধান বেনজীর আহমেদের সম্পদ নিয়ে একটি জাতীয় দৈনিকের প্রকাশিত অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে৷ পত্রিকাটির প্রতিবেদনে বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের বিপুল সম্পদের খোঁজ পাওয়ার দাবি করেছে, যা তার চাকরিজীবনের বৈধ আয়ের চেয়ে বহুগুণ বেশি৷ যিনি কিনা দারিত্বরত অবস্থায় রাষ্ট্রের শুদ্ধাচার পুরস্কার লাভ করেছেন, আবার মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা পেয়েছেন৷
বেনজীর আহমেদকে নিয়ে প্রতিবেদন নিয়েও নীতিনির্ধারণী মহলে এখন পর্যন্ত তেমন প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে না৷ বরং সামাজিক মাধ্যমে কেউ কেউ বলছেন, এই খবর অসাধুদের সরকারি চাকরির প্রতি আরো উৎসাহী করবে৷ এমন উচ্চপদে আসীন হয়ে কত সম্পদ গড়া যায় খবরটি তার বিজ্ঞাপন হয়ে উঠতে পারে ভবিষ্যৎ বেনজীর আহমেদদের কাছে৷
২০২২ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি তাদের এক জরিপে দেখিয়েছে, ২০২১ সালে বাংলাদেশে ৭০ দশমিক নয় শতাংশ খানা সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সেবা নিতে গিয়ে দুর্নীতির শিকার হয়েছে৷ তাদের জরিপে উঠে আসা ১৭টি খাতের মধ্যে শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত খাত হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা (সে সময় পুলিশের আইজিপি বা মহাপরিদর্শকের দায়িত্বে ছিলেন বেনজীর আহমেদ)৷ জরিপে ঘুষদাতা খানার ৭২ শতাংশ কারণ হিসেবে বলেছে ঘুস না দিলে সেবা পাওয়া যায় না৷
অর্থাৎ, সরকারি সেবা পেতে ঘুস দেয়াই অনেকটা প্রাতিষ্ঠানিক নিয়মে পরিণত হয়েছে৷ টিআইবির হিসাবে সেই সময়ে দেয়া মোট ঘুসের পরিমাণ ছিল প্রায় ১০ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা, যা ২০২০-২১ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের (সংশোধিত) পাঁচ দশমিক নয় শতাংশ৷ গত বছর উদ্বোধন হওয়া কর্ণফুলী টানেলের নির্মাণ খরচের চেয়েও যা বেশি৷
অথচ দুর্নীতি কমবে এমন প্রত্যাশায় ২০১৫ সালে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন শতভাগ বৃদ্ধি করা হয়েছিল৷ তাতে বহু তরুণের কাছে সরকারি চাকরি পাওয়া জীবনের লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে৷ বর্তমানে বেতন ও অবসরভাতা মিলিয়ে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের পেছনে বছরে সরকারের ব্যয় দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকা, যা দেশের বাজেটের প্রায় ১৫ শতাংশ৷ এত সুবিধার পরও কর্মচারীদের দুর্নীতির প্রবণতা ঠেকাতে সরকারের পদক্ষেপ ও সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে৷ আবার যতটুকু ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে সেখানে উচ্চপদের কর্মকর্তারা থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে৷ ২০২০ সালের ১১ নভেম্বর একটি পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দুর্নীতির মামলায় ২০১৬ সাল থেকে সে বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৭৯৯ জনকে গ্রেপ্তার করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক৷ তাদের মধ্যে ৩৯০ জন ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, যার মধ্যে ৯৭ শতাংশের বেশি ছিলেন নিম্ন পদের চাকরিজীবী৷ দুদকের বাইরে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে অন্য সংস্থাগুলোর ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে আইনি বাধা আছে৷
সরকারি চাকরি (সংশোধন) বিল অনুসারে ফৌজদারি মামলার মুখোমুখি হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া কাউকে গ্রেপ্তার করা যায় না৷ দুর্নীতি, দায়িত্বে অবহেলা সম্পর্কিত ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য৷ গত বছর এই আইন পাস করেছে সরকার৷ নতুন খবর হলো কর্মচারীদের সম্পদ বিবরণী জমা দেওয়ার যে বাধ্যবাধকতা ছিল সেটিও তুলে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে৷ এজন্য সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯ সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়৷
আগে প্রতি বছর সম্পদ বিবরণী জমা দেয়ার বিধান থাকলেও সরকার সেটি শিথিল করে পাঁচ বছর পর পর দেওয়ার বিধান করে৷ এখন এই বাধ্যবাধকতাও সরিয়ে দেয়া সরকারি কর্মচারিদের দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে উঠতে ব্যাপক উৎসাহ দেবে বলে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে টিআইবি৷
সব মিলিয়ে কঠোর অবস্থানের বদলে সরকার ক্রমাগতভাবে দুর্নীতির পথ যেন উল্টো প্রশস্ত করছে৷ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকারি কর্মকর্তাদের অনেকের আচরণ ও বক্তব্যে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীর চেয়ে তাদের দলীয় পরিচয়ই বেশি প্রকাশিত হয়েছে৷ যে অভিযোগ ছিল বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধেও৷ তাদের এবং সার্বিকভাবে আমলাতন্ত্রের উপর সরকারের অতি নির্ভরশীলতা উচ্চপদের কর্মকর্তাদের দুনীতি ও দায়মুক্তির বাড়বাড়ন্ত সুযোগ করে দিচ্ছে কিনা ভেবে দেখা প্রয়োজন৷