মতিন রহমান। জামালপুরের বকশীগঞ্জ পৌরসভার মালীরচর নয়াপাড়া গ্রামের ২৫০ বছরের পুরনো নীলকুঠির মাটি চাপায় হারিয়ে যাচ্ছে। নীল চাষের জন্য ব্রিটিশ শাসনামলে কৃষকদের উপর ইংরেজদের চালানো নির্মম নির্যাতনের চিহ্ন বহন করে চলছে এই ‘নীলকুঠি’র। সংরক্ষণের অভাবে নিঃশ্চিহ্ন ও দখল হয়ে যাচ্ছে ২৫০ বছরের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো। ফলে নতুন প্রজন্মের কাছে হারিয়ে যাচ্ছে এ উপজেলার পুরনো ইতিহাস।
সরেজমিনে জানা যায়, ইংরেজরা ২৫০ বছর আগে নীল চাষের জন্য ‘নীলকুঠির’ নামে একটি খামার স্থাপন করেছিল। এই অঞ্চলের মাটি উর্বর হওয়ায় ওই সময় এখানে বেশি নীল চাষ হতো। এ কারণে নীলকরদের আস্তানা গড়ে উঠে বকশীগঞ্জের মালীরচর নয়াপাড়া গ্রামে। মালীরচর নয়াপাড়া গ্রামটি বকশীগঞ্জ সদর থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার উত্তর দিকে অবস্থিত। অযত্নে অবহেলায় ও সংরক্ষণের অভাবে নিঃশ্চিহ্ন ও দখল হয়ে যাচ্ছে নীলকুঠির। নীলকুঠির জমি বিভিন্নভাবে দখল করে নিয়েছে বিভিন্ন লোক। স্মৃতি হিসেবে রয়েছে শুধুমাত্র নীলকুঠির কিছু ধ্বংসাবশেষ ও ভাঙাচুরা কিছু ইটের চিহ্ন। সেটিও মাটি চাপায় প্রায় নিঃশ্চিহ্ন হওয়ার পথে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৮০০ সালের দিকে মালীরচর নয়াপাড়া গ্রামে নীল চাষের একটি খামার স্থাপন করে ইংরেজরা।১৮৫০ সাল পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হলে নীল চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় কৃষকরা। তখন ইংরেজদের জুলুম ও নির্যাতনের শিকার হন তারা। ইংরেজরা নীলের ব্যবসা করে রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার বাসনা নিয়ে এই অঞ্চলে এসেছিলেন। আজ থেকে প্রায় আড়াইশ বছর আগে এখানে এসে মালীরচর নয়াপাড়া গ্রামের প্রায় ১০ একর জমির উপর নীলকুঠি স্থাপন করেন ইংরেজরা। কৃষকদের আপত্তির পরও তাদের উপর নির্যাতন চালিয়ে কৃষকদের বাধ্য করা হয় নীল চাষে। তবে যে জমিতে নীল চাষ করা হয় সেই জমিতে ধান বা অন্য কোনও ফসল ফলে না বলে বাধা দেয় কৃষকরা। নীল কুঠিয়াল ও তাদের দোসরদের অত্যাচারে এই অঞ্চলের কৃষকরা যখন জর্জরিত তখন কৃষকরা একত্রিত হয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলেন ও একটি বিশাল লাঠিয়াল বাহিনী গড়ে তোলে ইংরেজদের নীলকুঠির আক্রমণ করেন। আক্রমণের পর নীল কুঠিয়াল বাহিনী ও কৃষদের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ হয়।সংঘর্ষে ইংরেজ বাহিনী পরাজিত হয়। ফলে জুলুম, অত্যাচার থেকে রক্ষা পায় কৃষকরা।
স্থানীয় কৃষক আজামল মিয়া বলেন, এখানে অনেক লোকজন ঘুরতে আসে। এই পুরনো ঐতিহ্যকে ধরে রাখার জন্য রক্ষণাবেক্ষণ করা দরকার। তা না হলে মানুষ কিভাবে বুঝবে এখানে ইংরেজরা নীল চাষ করত আর নীল চাষ করার জন্য কৃষকদের বাধ্য করত কিন্তু কৃষকরা না করলে অত্যাচার করত। সেই ঐতিহ্যকে ধরে রাখার জন্য সরকারের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
কবি ও সাহিত্যিক রজব বকশী বলেন, এই পুরনো ঐতিহ্যকে ধরে রাখার জন্য এটি সংস্কার করা দরকার। এ দর্শনীয় স্থানটিকে দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে লোক আসে। প্রাচীনকালে ইংরেজরা এখানে নীল তৈরির কারখানা গড়ে তুলেছিল এবং নীল তৈরির জন্য কৃষকদের বাধ্য করত। নীল তৈরির কাজ না করলে তাদেরকে মারত। কালের বিবর্তনে এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। এটি দেখার একটি ঐতিহাসিক বিষয়। যদি ওইভাবে রক্ষণাবেক্ষণ না করা হয় তাহলে ইতিহাস থেকে ঐতিহ্য হারিয়ে যাবে। তাই আমি সরকারের কাছে সংস্কারের জোর দাবি জানাচ্ছি।
এ ব্যাপারে বকশীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার অহনা জিন্নাত বলেন বলেন, এই বিষয়ে আমি অবগত হয়ে সহকারী কমিশনার (ভূমি) আসমা-উল-হুসনাকে ঘটনা স্থল পরিদর্শন করতে পাঠিয়েছি। অভিযোগের সত্যতা পেলে আইনগত ব্যাবস্থা গ্রহন করা হবে।