
এক সময়ের চেতনায় তিনি ছিলেন স্বৈরাচার- গণতন্ত্রের শত্রু, আন্দোলনের প্রতিপক্ষ। ছাত্রজীবনের গলি-মাঠে তাঁর নামে উঠেছিল অসংখ্য স্লোগান, দেয়ালে লেখা হয়েছিল রাগ আর প্রতিশোধের ভাষা। হ্যাঁ, হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ- যাঁকে আমরা চিহ্নিত করেছিলাম স্বৈরাচারের প্রতীক হিসেবে, তাঁকেই আজ, জীবনের অনেকটা পথ পেরিয়ে এসে, দেখতে পাচ্ছি এক ভিন্ন আলোয়।
সময় বড় নির্মম শিক্ষক। সময়ের বদলে যাওয়া দিনগুলিতে যেসব শাসনের মুখোমুখি হয়েছি, তাদের তুলনায় এরশাদের শাসনকালের বহু দিক এখন ক্ষুদ্র ও তুলনামূলকভাবে “শিশুস্বৈরতন্ত্র” বলে মনে হয়। আজকের প্রেক্ষাপটে এসে বুঝি, দুর্নীতি, অপশাসন, দলীয়করণ, দমননীতি, লুটপাট- এসব এরশাদের সময় ছিল, কিন্তু তা যেন আজকের মতো নগ্ন, সর্বগ্রাসী এবং গগনচুম্বী ছিল না।
এরশাদের ‘নয় বছর’কে আমরা একসময় শুধুই ক্ষমতা কুক্ষিগত করার ইতিহাস ভাবতাম। কিন্তু সেই সময়েই পল্লী উন্নয়ন, গ্রাম সরকার ব্যবস্থা, শিক্ষা, নারী উন্নয়ন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি, ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতি সহনশীল দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা হয়েছিল। ‘পল্লীবন্ধু’ উপাধি কেবল একটি রাজনৈতিক চমক ছিল না- তার পেছনে ছিল তাঁর বাস্তব কিছু কর্মকাণ্ড, যেগুলোর প্রভাব আজও গ্রামবাংলার প্রান্তিক জনগণ টের পান।
আমরা তাঁর দুর্নীতির সমালোচনা করেছি- বাধ্য হয়েই। কিন্তু আজ দেখছি, কেউ কেউ একেকটা মেগা প্রকল্প থেকেই চুরি করছে দশগুণ, শতগুণ। একেকজন তরুণ রাজনীতিক মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই রচনা করছে লুটপাটের মহাকাব্য। তখন মনে পড়ে, যে মানুষটিকে এতদিন “দুর্নীতিবাজ” বলে গালি দিয়েছি, তিনি আসলে এখনকার অনেকের তুলনায় অনুপাতে ছিলেন অনেকটাই সংযত।
এতসব উপলব্ধির মুখে আজ, এরশাদের ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকীতে, গভীরভাবে অনুভব করি- আমরা অনেকটা একপাক্ষিক চেতনায় বিচার করেছিলাম তাঁকে। হ্যাঁ, ভুল তাঁর ছিল, বিতর্ক তাঁর ছিল, কিন্তু পূর্ণ সত্যের মধ্যে ছিল তাঁর মানবিকতা, তাঁর কিছু ইতিবাচক অবদান, এবং একটি সীমিত কাঠামোর মধ্যেও কিছু শাসকসুলভ নীতি।
আজ তাঁর আত্মার প্রতি জানাই শ্রদ্ধা। আমি ব্যক্তিগতভাবে, তাঁর নামের প্রতি যত গালি উচ্চারণ করেছি, যত কটাক্ষ করেছি- তা নিয়ে অনুতপ্ত। একজন মানুষ চলে যাওয়ার পর আমরা যখন আস্তে আস্তে উপলব্ধি করি তাঁর ভূমিকা, তখনই বুঝি- ইতিহাস একমাত্র ন্যায়বিচারক, আমরা কেবল তার যাত্রাপথের ক্ষণিক পথিক।
পল্লীবন্ধু হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ, আপনার আত্মা শান্তিতে থাকুক।